লাবন্য, সিলেটঃ মৃত্যু তার কাছে এসেও ফিরে গেছে বারবার! ভয়াবহ সব দুর্ঘটনার হাত থেকে শুধু নিজেই বেঁচে ফেরেননি বরং অন্যদেরও বাঁচিয়েছেন। নিজের জীবনের চিন্তা না করে শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও উদ্ধার করেছেন জাহাজডুবিতে পড়া যাত্রীদের। নিজ কর্মগুণে আজও ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন।
বলছি ব্রিটিশ নার্স ভায়োলেট জোসেপের কথা। ১৮৮৭ সালে আর্জেন্টিনায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তারা ৬ ভাই-বোন। জন্মের পরপরই ভায়োলেট যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন। তার বেঁচে থাকার আশা খুবই ক্ষীণ ছিল। তবুও শেষ রক্ষা পান তিনি। তার যখন ১৬ বছর বয়স; তখন তার বাবা মৃত্যু পথযাত্রী হওয়ায় তারা ইংল্যান্ডে চলে যান।
ভায়োলেট জোসেফ একজন জাহাজ “নার্স” হিসেবে তিনটি জাহাজের হয়ে কাজ করেছেন। টাইটানিক, ব্রিটানিক,অলিম্পিক। তার কর্মজীবন তিনটি জাহাজই দূর্ঘটনা ঘটে। অলিম্পিক জাহাজটি যুদ্ধ কবলিত হয়ে ঢুবে যায়। টাইটানিক জাহাজ হিমশৈলে আঘাত লেগে ঢুবে যায়। ব্রিটানিক গভীর জলে গিয়ে ঢুবে যায়। কিন্তু নার্স জোসেফ সকল দূর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে এসেছেন।
আরএমএস অলিম্পিক ছিল ব্রিটিশ জাহাজ। অলিম্পিকে ক্যারিয়ার ছিল ১৯১১ থেকে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত ২৪ বছর। ১৯১১ সালে, ভায়োলেট হোয়াইট স্টার জাহাজ আরএমএস অলিম্পিকের একজন নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। অলিম্পিক ছিল একটি বিলাসবহুল জাহাজ, যা তখনকার বৃহত্তম বেসামরিক লাইনার ছিল।
ভায়োলেট অলিম্পিকে যোগদানের পর জাহাজ যেদিন যাত্রা শুরু করে; সেদিনই আবহাওয়া ছিল খুবই খারাপ। ১৯১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ভায়োলেট প্রথম জাহাজ দুর্ঘটনার শিকার হন। সেদিন অলিম্পিক সাউদাম্পটন থেকে ছেড়ে ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজ এইচএমএস হকের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। যদিও এ দুর্ঘটনায় কোনো হতাহত হয়নি এবং ক্ষতি সত্ত্বেও জাহাজটি ডুবে না গিয়ে বন্দরে ফিরেছিল।
এরপর ভায়োলেটের বয়স যখন ২৪ বছর; তখন তিনি আরএমএস টাইটানিকে যোগ দেন। ১৯২১ সালের ১০ এপ্রিল আরএমএস টাইটানিকে নার্স হিসেবে আবারও নিযুক্ত হন ভায়োলেট। যাত্রা শুরুর ৪ দিন পর ১৪ এপ্রিল জাহাজটি উত্তর আটলান্টিকের একটি আইসবার্গে আঘাত লেগে বিধ্বস্ত হয়।
প্রায় ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট পরে ডুবেছিল বিশাল এ প্রমোদতরী। তিনি জীবনের তোয়াক্কা না করে জাহাজের যাত্রীদের উদ্ধার করার চেষ্টা করতে থাকেন। লাইফবোটে একে একে যাত্রীদের নামিয়েছেন নিজ হাতে। একটি শিশুকেও উদ্ধার করেছিলেন ভায়োলেট। এরপর লাইফবোটে ১৬ জনসহ বেঁচে ফেরেন এই নার্স।
১৫ এপ্রিল সকালে ভায়োলেটসহ জীবিত যাত্রীদের আরএমএস কার্পাথিয়া উদ্ধার করে। ভায়োলেটের মতে, তার কাছে থাকা ওই শিশুকে আরেক নারীর কাছে রাখেন কার্পাথিয়া জাহাজে ওঠার সময়। যে নারীর কাছে তিনি শিশুটিকে রাখতে দিয়েছিলেন, তিনিই সম্ভবত তাকে নিয়ে পালিয়ে যান!
টাইটানিক ট্র্যাজেডির ৪ বছর পর ভায়োলেট পুনরায় ব্রিটিশ রেড ক্রসের নার্স হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইচএমএইচএস ব্রিটানিক নামক একটি জাহোজের ক্রু হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। জাহাজটি যাত্রীবাহী থেকে একটি ভাসমান হাসপাতালে পরিণত হয়। যেটি সাগরেই ঘুরে বেড়াত। হঠাৎ একদিন জাহাজে আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটে।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় ভায়োলেট পানিতে লাফিয়ে পড়ার সময় জাহাজের সঙ্গে লেগে তার মাথা ফেটে যায়। বিস্ফোরণ ঘটার ৫৫ মিনিটের মধ্যে ব্রিটানিক জাহাজটি ডুবে যায়। ১০৬৬ জন যাত্রীর মধ্যে ৩০ জন ডুবে মারা যান। ভায়োলেটের শরীরে লাইফ জ্যাকেট থাকায় সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। এরপর উদ্ধারকারীরা তাকে লাইফবোটে উঠিয়ে নেন।
একজন নার্স হিসেবে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরলেও ভায়োলেট তার পেশাকে কখনো ছোট করে দেখেননি। পরবর্তী জীবনে রেড স্টার লাইন, রয়েল মেল লাইনসহ বিভিন্ন সংস্থায় (শিপিং সংস্থা) কাজ করেছেন। ৬৩ বছর বয়স পর্যন্ত কাজ করে গিয়েছেন ভায়োলেট। তবে তিনি এরপর থেকে কখনো বড় কোনো জাহাজে ওঠেননি।
১৯৫০ সালের দিকে এক ঝড়ের রাতে ভায়োলেটের কাছে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির ফোন আসে। তার কাছে ওই ব্যক্তি জানতে চান, তিনি কি টাইটানিক ডুবে যাওয়ার সময় একটি শিশুকে বাঁচিয়েছিলেন? ভায়োলেট উত্তরে জানান, ‘জ্বি’। তখন অপর প্রান্ত থেকে ওই ব্যক্তি জানান, ‘আমি সেই শিশু’।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, ভায়োলেট তার পরবর্তী জীবনে ওই শিশুর কথা কাউকে জানাননি। ভায়োলেট ‘মিস আনসিঙ্কেবল’ নামে ইতিহাসে পরিচিত হয়ে আছেন।
এসব দূর্ঘটনার পরে তিনি A Night to Remember ও ভৌতিক The Deep সিনেমায় অভিনয় করেন।
১৯৭১ সালে ৮৮ বছর বয়সে কনজেসটিভ হার্ট ফেইলুরের কারণে মারা যান এ সাহসী নার্স।
সূত্র: হিস্টোরি বাই ডে ও মিউজিয়াম হ্যাক।
অনুবাদঃ bdnursing24 (imam, labonno, motiur, shanto, arif, nasir)