ছৈয়দ আহমেদ তানশীর উদ্দিন: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন ‘বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো।’ এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ‘একটি স্বাধীন, সার্বভৌম সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার।’
বাংলার মানুষের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে প্রাধান্য দিয়েছেন অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে। তাই তিনি প্রজ্ঞার আলোকে গঠিত ১৯৭২ সালে সংবিধানের ১৫ (ক)অনুচ্ছেদ জীবনধারণের সকল মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থাকরণ রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব এবং ১৮ (১) অনুচ্ছেদে জনগণের পুষ্টির স্তর উন্নয়ন ও জনস্বাস্থের উন্নতিসাধন রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
মৌলিক বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি গ্রহণ করেছিলেন রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং রাষ্ট্রীয় নীতিমালা। বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন একটি সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়তে হলে, চাই একটি স্বাস্থ্যবান জাতি। এজন্য তিনি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে যেমন গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি গ্রহণ করেছেন সময়োপযোগী পদক্ষেপ।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা, অবকাঠামো রেখে গেছেন যার ওপরে গড়ে উঠেছে আজকের বিশ্বনন্দিত অনেক কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধুর তৃণমূল পর্যায়ে চিকিৎসা সেবার জন্য থানা স্বাস্থ্য প্রকল্প আজও বিশ্বে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার এক সমাদৃত মডেল।
বঙ্গবন্ধুর পদক্ষেপের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য রয়েছে-
১. আইপিজিএমআর (পিজি হাসপাতাল)-কে শাহবাগে পূর্ণাঙ্গ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল হিসেবে স্থাপন।
২. বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) প্রতিষ্ঠা।
৩. বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান এ্যান্ড সার্জন্স (বিসিপিএস) প্রতিষ্ঠা।
৪. স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন।
৫. ১৯৭৩ সালে প্রণীত প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনাকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান।
৬. চিকিৎসকদের সরকারি চাকরিতে ১ম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান।
৭. নার্সিং সেবা এবং টেকনোলজির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা ও নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ।
৮.কম উন্নয়শীল দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মূলনীতি হলো- Prevention is better than cure-এ নীতিকে বাস্তবায়ন করার জন্য তিনি স্থাপন করার চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীতে নিপসম-১৯৭৮ সালে চালু করা হয়।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর সুদীর্ঘ ২১ বছর চলেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীত ধারায় পাকিস্তানী ভাবধারা অনুসরণ করে। যে কারণে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল উন্নয়ন ব্যাহত হয়, বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নার্সিং পেশা নিয়ে বলেছিলেন- ‘আমি রোগী হয়ে দেখেছি, ঘুরে দেখেছি। আমাদের নার্সিং যেন আমাদের সমাজের জন্য একটি অসম্মানজনক পেশা। আমি বুঝতে পারি না এ সমাজ কি করে বাঁচবে। একটা মেয়ে দেশের খাতিরে নার্সের কাজ করছে ,তার সম্মান হবে না আর ভালো কাপড় চোপড় পরে যারা ঘুরে বেড়াবে তার সম্মান হবে অনেক উচ্চে, চেয়ারখানা তাকেই দেয়া হবে। এরও একটা মান থাকতে হবে। আমি ডাক্তার সাহেবদের সাথে পরামর্শ করেছিলাম যে, আপনারা আমাকে একটা প্লান দেন, যাতে আইএ পাশ এবং গ্রাজুয়েট মেয়েরা এখানে আসতে পারে।’
একজন সফল রাষ্ট্র নায়কের এমন মন্তব্যই প্রতিফলিত করে নার্সিং পেশাকে সমুন্নত করবার চেষ্টা ছিল তার।
তবে এটি সত্যি যে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজগুলো তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা দায়িত্ব গ্রহণ করার পর নার্সদের কোন আন্দোলন করতে হয়নি, বিষয়গুলো উনার নজরে আনলেই বাস্তবায়ন হয়েছে। দ্রুতই নার্সদের সকল দাবি পূরণ হয়েছে। বাস্তবায়ন হচ্ছে গণমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সকল কার্যক্রম।
ক. নার্সদের মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ৩য় শ্রেণি থেকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে।
খ. ২০০৯ সাল থেকে অদ্যবধি প্রায় ২৪ হাজার ৭শ’ নার্স নিয়োগ দেয়া হয়েছে, আরও চলমান রয়েছে।
গ. নার্সিং জনশক্তি বৃদ্ধির জন্য ১২টি নতুন নার্সিং ইনস্টটিউটে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছেন। ১১টি ইনস্টিটিউটকে কলেজে উন্নীত করা হয়েছে। বর্তমানে ৪৩টি নার্সিং ইনিস্টিটিউট ও ১১টি কলেজে নার্সিং শিক্ষা কার্যক্রম চলমান।
ঘ. নার্সদের উচ্চ শিক্ষার জন্য মুগদায় কোরিয়ান সরকারের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে National Institute of Advanced Nursing education and Research (NIANER)। যেখানে ইতোমধ্যে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়েছে,
ঙ. নতুন করে জনবল কাঠামোসহ নার্সিং ও মিডওয়াইকারী অধিদফতর সৃষ্টি করা হয়েছে,
চ. বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইকারী কাউন্সিল আইন ২০১৬ প্রণয়ন করা হয়েছে।
ছ. নার্স তৈরির লক্ষে বেসরকারিভাবে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেপিজে মেমোরিয়াল নার্সিং কলেজ অন্যতম।
নার্স হিসেবে গর্ববোধ করি আমরা। জাতির পিতার অনুপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী যেভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাতে বিশ্ব মাঝে বাংলাদেশ একদিন নার্সিং খাতে রোল মডেল হবে।
লেখক : ছৈয়দ আহমেদ তানশীর উদ্দিন নার্সিং কর্মকর্তা, জেলা সদর হাসপাতাল, কক্সবাজার।