শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৩৬ পূর্বাহ্ন

প্রগতিশীল নার্সিং ব্যবস্থার প্রত্যাশি ছিলেন তাছলিমা বেগম -রহিমা জামাল আখতার

Reporter Name
  • Update Time : শুক্রবার, ২৫ জুন, ২০২১
  • ৪১৪ Time View

সম্পাদকীয়/ বিডিনার্সিং২৪ঃ আমাদের অনেকের প্রিয় তাছলিমা আপা আর নেই। গত ১৯ জুন রাত ৮.৩২ মিনিটে রাজধানী ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ডাক্তার তাঁর মৃত্যুর কথা জানালে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও পারিবারিক সুত্রে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আমরা তা জানতে পারি। তিনি অশীতিপর বৃদ্ধা মা, স্বামী-সন্তান-নাতনী ও পরিবারের সদস্যসহ বাংলাদেশের নার্সেস সমাজের অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ২০১৭ সালের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁর লিভার চিরোসিস্ রোগ ধরা পড়ে এবং তিনি ধারাবাহিকভাবে চিকিৎসাধীন ছিলেন। অসুস্থ থাকলেও প্রায় প্রতিবারের মত এবছরও (২০২১সাল) বৃদ্ধা মাতাসহ পরিবারের সাথে ঈদ উৎযাপন করতে যশোরে নিজ বাড়িতে যান। শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে গত ২২ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত তিনি যশোরে একটি বেসরকারি হাসপাতাল ইবনে সিনায় ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেন। বাড়ি ফিরেও তাঁর শারিরীক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। এ পরিস্থিতিতে গত ১৭ জুন তাঁর শারিরীক অবস্থার আরও অবনতি হলে ১৮ জুন তাঁকে পুনরায় যশোরের ঐ বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকের পরামর্শে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ১৯ জুন ঢাকায় এনে ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাকালীন সময়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৬ বছর। ২০ জুন বাদ যোহর যশোরের বেজপাড়া কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

প্রয়াত তাছলিমা বেগম ১৯৫৫ সালের ৩০ আগস্ট যশোর শহরের বেজপাড়ায় পৈত্রিক বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শিক্ষক পিতা মরহুম মো.শাহাদাত উল্লাহ এবং মাতা গৃহিনী মনোয়ার বেগমের ছয় সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে যশোরের মধুসূদন তারাপ্রসন্ন (এমএসটিপি) বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন এবং সিটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। সমসাময়িক সময়ে তিনি তৎকালীন যশোহর নার্সিং ট্রেনিং সেন্টারে (পরবর্তীতে নার্সিং ইনস্টিটিউট) ভর্তি হয়ে ১৯৭৩ সালে তিন বছরের সিনিয়র সার্টিফিকেট ইন নার্সিং ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রজীবনে তিনি পারিবারিক সুত্রে প্রগতিশীল বাম সংগঠনের প্রভাবে দেশের শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের সেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করার মানসিকতা ধারণ করেন। তাঁর নিকটাত্মীয় মানিকমামা ও তার সহযোদ্ধদের প্রভাব আরও গভীর হয় ১৯৭১ সালে যশোরের মনিরামপুরের চিনিটোলায় পাঁচ কমিউনিস্ট বিপ্লবী নেতা আসাদ, তোজো, শান্তি, ফজলু, মানিকমামার শহীদ হওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে। এভাবে তিনি জনগণের সেবা করার আদর্শ লালন করেন। আর এই আদর্শবোধের প্রতিফলন ঘটে তার কর্মজীবনে।

তাঁর চাকরি জীবনের সূচনা হয় মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে ১৯৭৪ সালের ২৫ জুলাই রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদানের মধ্য দিয়ে। উল্লেখ্য, সার্ভিস সেক্টরে নার্সিং জনসম্পদের সংকট থাকায় সে সময় তিন বছরের নার্সিং ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জনের সাথে সাথে নার্সদের চাকরি হত। একই বছরের শেষ দিকে তিনি মাগুরা আধুনিক সদর হাসপাতালে বদলী হয়ে আসেন। এরপর ১৯৭৫ সালের জুলাইয়ে তিনি যশোহর সদর হাসপাতালে আসেন। কর্মরত অবস্থায় ১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা নার্সিং ইনস্টিটিউট থেকে এক বছরের মিডওয়াইফারি ডিগ্রি অর্জন করেন। এসময় তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মরহুম জননেতা মওলানা ভাসানীর সেবা করার সুযোগ পান। তৎকালীন দেশের একমাত্র নার্সিং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কলেজ অব নার্সিং, মহাখালী, ঢাকা থেকে ১৯৮৩ সালে তিনি বিএসসি নার্সিং ডিগ্রি অর্জন করেন। বিএসসি পাশ করার পরপরই তিনি যশোর নার্সিং ইনস্টিটিউটে নার্সিং ইনস্ট্রাকটর ইনচার্জ হিসাবে ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯২ সালে তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বৃত্তি নিয়ে ভারতের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইকিয়াট্রিক নার্সিংয়ে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ডিস্টিংশনসহ প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফেরার পর তিনি কলেজ অব নার্সিংয়ে প্রভাষক পদে যোগ দেন। কলেজে থাকাকালে তিনি ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত নার্সিং রিসার্চ সেলের কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে কলেজ অব নার্সিংয়ে বাংলাদেশে প্রথম অস্ট্রেলিয়ার এ্যাডেলেইড ইউনিভার্সিটির অফশোর এমএসসি ইন নার্সিং ডিগ্রি চালু হলে তিনি সেখানেও কোঅর্ডিনেটরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের মে মাসে তিনি সেবা পরিদপ্তরে প্রজেক্ট অফিসার পদে (বর্তমানে আপগ্রেডেড ডিজিএনএম-এ পদটি অবলুপ্ত) যোগ দেন। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি পরিচালক পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন এবং ২০১৪ সালের ২৮ আগস্ট সরকারী চাকরী থেকে অবসরে যান। পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণের পর বেসরকারি কেপিজে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব নার্সিং কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে থাকাকালীন ২০১৭ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার প্রয়োজনে তিনি ঢাকাতে অবস্থান করেন এবং ২০১৯ সালের এপ্রিলে তিনি ঢাকার ইউনিভার্সেল নার্সিং কলেজে অধ্যক্ষ হিসাবে যোগ দেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানেই অধ্যাপক ও মেন্টর হিসাবে কর্মরত ছিলেন।

নার্সিং পেশায় তাছলিমা বেগমের দীর্ঘ চল্লিশ বছরের কর্মবহুল জীবনের দিকে তাকালে দেখা যায় তিনি জনদরদী, গণমুখী প্রগতিশীল চিন্তাধারার অধিকারী ছিলেন। ক্লিনিক্যাল নার্স, শিক্ষক-প্রশিক্ষক, গবেষক, প্রশাসক ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় বিশেষত নার্সিংয়ের ক্ষেত্রে তিনি পেশাদার ব্যক্তিত্ব ছিলেন। রোগীর শয্যা পাশেই শুধু নয়, বরং নার্সদের শারিরীক অসুস্থতা ও মানসিক সমস্যায় তাঁর নিবেদিত ভূমিকা অনুকরণীয়।

তিনি দীর্ঘদিন এদেশে একমাত্র উচ্চশিক্ষিত সাইকিয়াট্রিক নার্স ছিলেন। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএসসি নার্সিং কোর্সের প্র্যাকটিকাল সাইকিয়াট্রিক নার্সিং বইটি তিনি সম্পাদনা করেন। নার্স শিক্ষক হিসাবে তিনি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানেই শুধু যতœশীল ছিলেন না বরং তিনি প্রকৃত উচ্চশিক্ষিত পেশাদার নার্স গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের অনেকের কাছে ভাবগম্ভীর, কারো কাছে কড়া শিক্ষক মনে হলেও তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রকৃত শিক্ষক। তাঁর বাৎসল্য-স্নেহের কারণে অধিকাংশ ছাত্র-ছাত্রীদের নিকট তিনি ছিলেন জনপ্রিয়। সিনিয়রদের কাছে গ্রহণযোগ্য, সহকর্মীদের কাছে সহমর্মী ও বন্ধু-বৎসল, এমনকি জুনিয়ররা তার সাথে অবলীলায় বহু বিষয়ে আলোচনা করতে পারতো। তবে তিনি বিষয়গুলো বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখার চেষ্টা করে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে কাজ করতেন।

বাংলাদেশে নার্সিং পেশায় গবেষণা কার্যক্রম বলতে গেলে নতুন। তাছলিমা বেগম নিজে যেমন গবেষণামূলকভাবে বিষয়বস্তুকে দেখতেন এবং গবেষক ছিলেন, তেমনি বাংলাদেশের নার্সিং গবেষণা কার্যক্রমে তাঁর ভূমিকা ছিল দায়িত্বশীল ও গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে নার্সিং গবেষণায় টিমওয়ার্ক গড়ে ওঠে। সহজবোধ্য করে নার্সদের রিসার্চ সংক্রান্ত প্রথম ম্যানুয়াল ২০০২ সালে প্রকাশিত “রিসার্চ মেথডলজি ফর নার্সেস” তৈরিতে তার ছিল গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ।

নার্সিং পরিচালক হিসাবে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নার্সিং সেক্টরে নিয়মের মধ্যে থেকে কাজ করতে চেয়েছেন। নার্সিংয়ে দীর্ঘদিন সরকারি নিয়োগ বন্ধ থাকায় নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে বয়সসীমা পার হয়ে যাওয়া নার্সদের চাকুরির সুযোগ নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালের নিয়োগের সময় বয়স প্রমার্জন সাপেক্ষে সরকারি চাকরি প্রদানে তাঁর বলিষ্ঠ ভূমিকা ও লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়তা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে। রূপান্তরিত সাত নার্সিং কলেজের পদসৃজনেও তাঁর ভূমিকা রয়েছে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে নার্সিংয়ে মাস্টার্স শিক্ষা কার্যক্রম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর ক্ষেত্রে আন্তজার্তিক মহলের তৎপরতাকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়ে জাতীয় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট অর্থাৎ National Institute of Advanced Nursing Education and Research (NIANER) প্রতিষ্ঠা তাঁর সময়কালে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সেবা পরিদপ্তরের জন্য নিজস্ব ভবনের জায়গা বরাদ্দের কাজটি তার সময়েই সম্পন্ন হয়। এতদসত্ত্বেও নার্সিংয়ের বিকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্নমুখী প্রবণতা, প্রতিবন্ধকতা এবং প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার অংশ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করে নার্সিং সমাজের চাহিদা পুরণ করতে না পারায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনেকের মধ্যে প্রতিক্রিয়া থাকলেও স্বপদে বহাল থেকে তাঁর একার পক্ষে সকলের আকাক্সিক্ষত ভূমিকা নেওয়া সম্ভব ছিল না।

বিশিষ্ট নার্সিং ব্যক্তিত্ব শিক্ষাবিদ, গবেষক, প্রশাসক তাছলিমা বেগমের মৃত্যুতে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব এবং সহকর্মী নার্সদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি। তাঁর মৃত্যুতে নিছক শোক প্রকাশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না বরং শোককে শক্তিতে পরিণত করে নার্সিং সার্ভিসকে একটি পূর্ণাঙ্গ ও সামগ্রিক ব্যবস্থা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার তাঁর অসমাপ্ত দায়িত্ব পালনে দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করতে হবে। একই সাথে তাঁর জীবন ও কর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে আদর্শবান, সৎ, নীতিনিষ্ঠ পেশাদার নার্স হিসাবে নিজেদেরকে গড়ে তুলতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। সংঘাতময় বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রচলিত বিশ্ব ব্যবস্থার চরম অবক্ষয় জাতীয় জীবনে ভয়াবহ অনৈতিক-অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে, যা দেশের বিভিন্ন পেশা ও কর্মজীবীদের মধ্যে আত্মকেন্দ্রিকতা, ব্যক্তিচিন্তা-ব্যক্তিস্বার্থ, অনাদর্শিক কায়েমী স্বার্থান্বেষী চিন্তা, স্বার্থপরতা, আত্মপ্রতিষ্ঠার হীনমন্যতা প্রতিফলিত হয়ে সমাজ ও জনজীবনকে গ্রাস করে চলেছে। এ সময় আমাদের প্রয়োজন জনগণের স্বার্থে প্রগতিশীল, আদর্শবান, নীতিনিষ্ঠ নার্সিং তথা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং প্রচলিত আর্থসামাজিক ব্যবস্থার পরিবর্তে জনগণের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। তাহলে তাছলিমা বেগমের মৃত্যুকে তাৎপর্যমণ্ডিত করা হবে। (২৪-৬-২০২১)

লেখকঃ রহিমা জামাল আখতার

লেখকঃ রহিমা জামাল আখতার

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2021
Design & Developed by Freelancer Zone
themesba-lates1749691102