কী হবে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেলে?
এই তো কয়েক মাস আগেই, সেপ্টেম্বরে ঘোষণা দেয়া হল, সামনের বছর ব্রিটিশ রাজ পরিবারের কোল জুড়ে আসছে নতুন শিশু। সেই আনন্দের রেশ না ফুরোতে ফুরোতেই বাতাসে ভাসছে আরেক সুসংবাদ। এই বছরের এপ্রিল নাগাদ আরেকটা রাজকীয় বিয়ে দেখতে যাচ্ছে সারা পৃথিবী- প্রিন্স হ্যারি এবং মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কলের। জন্ম, বিয়ের এই সুসময়ের মাঝে কৌতুহলী মানুষ একবার কল্পনা করতেই পারে কি হবে যদি মৃত্যু এসে ছোবল দিয়ে যায় এই চাঁদের হাটে?
এবং সেটা যদি হয় স্বয়ং রানীর মৃত্যু?
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মাত্র ২৫ বয়সে সিংহাসনে বসার পর কেটে গেছে সুদীর্ঘ ৬৪টি বছর। এর মধ্যে ১৩ জন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, ১২ জন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছে বিশ্ব। এতগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনার স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে কালে কালে রানীর বয়স এখন ৯০ বছর। তাই এখন, কোনো না কোনো পর্যায়ে রানীর মৃত্যু নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করা একদম অস্বাভাবিক কিছু না।
গত বছরের ক্রিসমাসে প্রিন্স হ্যারির বাগদত্তা মেগান মার্কেলের সাথে রানী এলিজাবেথ; Source: Perthnow.com
কী হবে তখন?
মৃত্যুর পর থেকে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া, পরবর্তী রাজার অভিষেকের মাঝের কমপক্ষে ১২ দিন পুরো ব্রিটেনে থমথমে ভাব বিরাজ করবে। এই ঘটনার জের ধরে বিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি ক্ষতি হবে ব্রিটিশ অর্থনীতির । শুধু তা-ই না, রানীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং তার পর পর অভিষেক- এই দুদিনই জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হবে, যার কারণে বন্ধ থাকবে ব্যাংকের সকল লেনদেন, স্টক মার্কেট, সকল প্রতিষ্ঠান। আর তাতে গুণতে হবে বিলিয়নের উপর ক্ষতিপূরণ।
আসলে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি দিয়ে এই ঘটনার ভয়াবহতার মাত্রা বোঝানো সম্ভব না। রানীর চলে যাওয়া এমনই অভূতপূর্ব কিছু হবে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যা কেউ কোনদিন দেখেনি। ছোটখাট অনেক পরিবর্তন আসবে এ সময়ে- বিবিসি তার সমস্ত কমেডি শো বাদ দিয়ে দেবে, প্রিন্স চার্লস খুব সম্ভবত তার পদবী পরিবর্তন করবেন, এমনকি ব্রিটেনের জাতীয় সংগীতে কথা পর্যন্ত বদলে যাবে! শুধু তা-ই না, রানীর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ ভেঙ্গে যাবে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
এর আগে, প্রিন্সেস ডায়ানা এবং রানী মাতার মৃত্যুর পর পর পুরো ব্রিটেনে আছড়ে পড়েছিল শোকের ঢেউ। মানুষ হয়ে পড়েছিল হিস্টিরিয়াগ্রস্থ। কিন্তু রানী এলিজাবেথের চিরবিদায় হবে একেবারে অন্য মাত্রার কিছু।
রানীর দীর্ঘজীবিতায় মানুষ এতটাই অভ্যস্ত যে, যুক্তরাজ্যের বিশাল একটা অংশ সারাজীবন ধরে রানীকে দেখে আসছে। তাই, তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরের সময়টা হবে অদ্ভুত এক অনিশ্চয়তার সময়।
আজ থেকে প্রায় ষাট বছর আগে এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে। এরপর বিশ্ব খুব দ্রুত বদলে গেছে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে কীভাবে সামলানো হবে সবকিছু, তা এখনো ধোঁয়াটে।
প্রথম প্রহর
মৃত্যুর ঠিক পর পরের সময়টা কেমন হবে তা অনেকটা নির্ভর করে রানীর মৃত্যু কীভাবে হচ্ছে। যদি তিনি লম্বা সময় ধরে অসুস্থ থাকেন তবে খুঁটিনাটি সব পরিকল্পনা আগে থেকেই করা থাকবে। এবং সেটা ইতিমধ্যে হয়েও গেছে। বাকিংহাম প্যালেসের ভেতরে রানীর মৃত্যু সংক্রান্ত সাংকেতিক ভাষা হচ্ছে ‘লন্ডন ব্রিজের পতন হয়েছে’ (London Bridge is down)।
কিন্তু যদি সেটা হয় আকস্মিক মৃত্যু, যেমনটা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে প্রিন্সেস ডায়ানার বেলায়? তাহলে খবর দাবানলের মতো সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়বে, প্যালেসের ভেতর থেকে খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না সেটাকে।
তবে যেভাবেই হোক, খবর জানার সাথে সাথে সেটা প্রাসাদের অধিকাংশ কর্মীদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হবে। (ডেইলি বিস্ট এর সূত্রমতে, যদি রাত্রে ঘটনাটি ঘটে তবে পরদিন সকাল ৮ টায় ঘোষণা দেয়া হবে)।
যদি আমরা ধরে নিই যে, রানীর চিরবিদায় একটি প্রত্যাশিত ঘটনা, তবে সারা পৃথিবীর মানুষ তা জানবে টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে। সব বিবিসি চ্যানেল তাৎক্ষণিকভাবে তাদের সমস্ত অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেবে। অন্য টিভি চ্যানেলগুলোকেও যে অনুষ্ঠান বন্ধ করতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই- তবে সবাই করবে কেউ বলে না দিলেও।
বিবিসি’র ঘোষকরা এরকম পরিস্থিতির জন্য সবসময় তৈরি হয়েই থাকেন, যাতে হঠাৎ খবর জানার পর একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে না যান! কুইন মাদার এর মৃত্যু সংবাদ দেয়ার সময় বিবিসির ঘোষক পিটার সিজনস তোপের মুখে পড়েছিলেন, কারণ সেসময় তার পরনে ছিল লাল টাই। এরপর থেকে বিবিসি’র অফিসে কালো টাই আর স্যুট সবসময় মজুদ থাকে এরকম পরস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য।
সংবাদ পরিবেশকদেরকেও বিভিন্ন সময় ড্রিলের ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যেখানে তাদেরকে হুট করেই একটা খবর পড়তে বলা হয় যেটা আগে কখনো ঘটে নি। এরকম একটা ড্রিল চলাকালীন সময়ে, বিবিসির এক সাংবাদিক ভুলবশত টুইট করেছিল যে রানী মারা গেছেন (ওই একই দিনে কাকতালীয়ভাবে রানী হাসপাতালে গিয়েছিলেন)। আসলে সে বুঝতে পারে নি যে সেটা রিহার্সাল ছিল। তার সেই টুইট সত্য ভেবে লুফে নিয়েছিল অনেক বিদেশি গণমাধ্যম।
সব কমেডি শো সম্প্রচার বাতিল হয়ে যাবে
শেষবার, ১৯৫২ সালে যখন সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ যখন মারা যান, তখন বিবিসি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সব ধরনের কমেডি শো প্রচার বাতিল করে দিয়েছিল। এবারও রানী এলিজাবেথের বেলায়ও একই কাজ করবে বিবিসি বলে মন্তব্য করে দ্য ডেইলি মেইল।
সিএনএন ইতোমধ্যেই রানীর জীবনকাহিনী নিয়ে ভিডিও তৈরি করে রেখেছে যেটা কিনা খবর পাওয়ার সাথে সাথে সেকেন্ডের নোটিশে প্রচার করা হবে। বাকি প্রধান প্রধান খবরের চ্যানেলগুলোও একইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যেতে পারে যদি কর্মঘণ্টায় সংবাদটি পৌঁছায়। সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কী ধরনের প্রোটোকল মানবে সেগুলা সম্পর্কে নির্দেশনা আসবে শিল্প, গণমাধ্যম ও ক্রীড়া অধিদপ্তর থেকে। তবে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের বাহিরে রানীর মৃত্যু নিয়ে সরকারের মধ্যে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কেমন হবে সেটা এখনই আঁচ করা যায় না।
প্রোক্লেমেশন ডে বাদে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরের দিনগুলোতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে যেন এক জাতির সমস্ত শোক শুষে নিয়ে তার ভারে নুয়ে পড়েছে সেটা। গির্জার শান্ত সমাধিত ঘণ্টাগুলো বাজতে থাকবে বিরতি দিয়ে।
ব্রিটিশ রাজপরিবার সংক্রান্ত এত বড় একটা ঘটনা যে শুধু ব্রিটেনেই আলোড়ন তুলবে তা কিন্ত না। পুরো বিশ্ব জুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে এটাকে কেন্দ্র করে। দীর্ঘ সময়ের জন্য সব দেশে শীর্ষ খবরের থাকবে এটি। সারা বিশ্বের গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলোতে ফলাও করে প্রচার হবে সর্বশেষ অবস্থা। বিদেশে যুক্তরাজ্যের এতখানি প্রভাব শুধু কিন্তু দূতাবাসগুলোর জন্যই নয়, রাজতন্ত্রের প্রাক্তন উপনিবেশগুলো এবং কমনওয়েলথ- যারা রাজদণ্ডের প্রতি বিশ্বস্ততায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং অন্যান্য ইংরেজি ভাষা জানা দেশগুলোর জন্যও।
ব্রিটিশ রাজতন্ত্র একসময় দখল করেছিল পুরো পৃথিবীর চারভাগের একভাগই। সেই উপনিবেশগুলো এখন নেই সত্য। কিন্তু মানুষের মন থেকে প্রভাব এত সহজে মুছে যায় না। কোথায় যেন সেটার ছাপ এখনো রয়ে গেছে। রানীর সেসব প্রাক্তন প্রজাদের মনোযোগের কেন্দ্রে থাকবে এই সংবাদটি।
প্রাসাদের অন্দরমহলে
বদ্ধ দরজার পেছনে লোকচক্ষুর অন্তরালে সেইন্ট জেমস প্যালেসে গঠিত হবে একটি উত্তরাধিকার কাউন্সিলের, যারা ঠিক করবে এরপর রাজমুকুটটি কে পরতে যাচ্ছে। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে, রানী এলিজাবেথের পুত্র প্রিন্স চার্লস হতে যাচ্ছেন পরবর্তী রাজশাসক। সবাই এটা ইতোমধ্যেই জানে, শুধু আনুষ্ঠানিকতাই বাকি!
এই কাউন্সিলে থাকবেন প্রিভি কাউন্সিলরগণ, লর্ডস, লন্ডন সিটির লর্ড মেয়র, কয়েকটি কমনওয়েলথ দেশের হাইকমিশনারগণ প্রমুখ। এই কাউন্সিলের যে এই নতুন সম্রাটের অভিষেক আনুষ্ঠানিকভাবে সবাইকে জানাতে হবে তা নয়- রানীর মৃত্যুর পর মুহূর্ত থেকেই প্রিন্স চার্লস ব্রিটিস সাম্রাজ্যের সম্রাট।
প্রিন্স চার্লসের উপাধি পরিবর্তন
বেশ অনেকদিন ধরেই একটি সম্ভাবনার কথা মানুষের মুখে মুখে চাউর হয়ে আসছে সেটা হল- ‘’যদি রাজমুকুট চার্লসকে ডিঙ্গিয়ে প্রিন্স উইলিয়ামকে দেয়া হয়?’’ অবশ্য প্রিন্স উইলিয়াম নিজের মুখেই সেটা উড়িয়ে দিয়েছে এটা বলে যে এরকম কিছু হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। বরং রানীর তিরোধানের পর উইলিয়াম হবে “প্রিন্স অফ ওয়েলস”- চার্লসের বর্তমান উপাধি।
হাজার হোক, প্রিন্স চার্লস তার সারাটা জীবন ধরে রাজা হওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন! তার মায়ের দীর্ঘজীবিতার কারণে খুব কম করে হলেও তার বয়স ৬৮ হওয়ার আগে তিনি পাচ্ছেন না সিংহাসন।
কাউন্সিলে নতুন সম্রাট (প্রিন্স চার্লস খুব সম্ভবত) পার্লামেন্ট এবং চার্চ অফ ইংল্যান্ডের কাছে তার আনুগত্য প্রকাশ করবে এবং তিনি হবেন চার্চের নতুন সুপ্রিম গভর্নর। তবে প্রিন্স চার্লসকে যে “কিং চার্লস” হতেই হবে এমন কোন কথা নেই। তিনি চাইলেই তার খ্রিস্টান নাম থেকে একটা পছন্দ করতে পারে। তাই, প্রিন্স চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ যদি চান, তবে অভিষেকের পর তার নাম হতে পারে “কিং ফিলিপ” অথবা “কিং আর্থার” অথবা “কিং জর্জ”।
রানীর মরদেহ থাকবে জনসাধারণের সম্মান জ্ঞাপনের জন্য উন্মুক্ত
বাকি সব আনুষ্ঠানিকতার মাঝে চলতে থাকবে রানীর কফিন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তুতি। কিন্তু এর আগে, দুই পার্লামেন্ট হাউজ একসাথে বসবে নতুন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য জ্ঞাপনের জন্য। তারা নতুন করে লেখা শপথ বাক্য পাঠ করবে এবং শোকজ্ঞাপন করবে। এরপর, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পর্যন্ত দুই হাউজই সাময়িকভাবে বহিষ্কৃত থাকবে।
কফিন আনার এক ছোট্ট অনুষ্ঠানের পর রানীর মরদেহ ওয়েস্টমিনিস্টার হলে শায়িত থাকবে। তারপর থেকে, দিনে একটি ঘন্টা ব্যতীত বাকি সময় আপামর জনগণ তাদের শ্রদ্ধা জানাতে পারবে ফুল দিয়ে, রানীকে এক নজর দেখে। এভাবে তিনদিন কেটে যাওয়ার পর রানীর শোকাহত প্রপৌত্রদ্বয় প্রহরীদের সরিয়ে নিজেরা কিছুক্ষণের জন্য পাহারায় থাকবেন রানীর কফিনের। একে বলে ‘ভিজিল অফ দ্য প্রিন্সেস‘ (Vigil of the Princes)। রাজা পঞ্চম জর্জের ক্ষেত্রেও একই রকম আনুষ্ঠানিকতা মেনে চলা হয়েছিল।
প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যুর পর মানুষ যেভাবে শোকাচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল তা থেকে সহজেই অনুমেয় যে, রানীর বেলায় কেমন হতে যাচ্ছে মানুষের অনুভূতি। সেসময়, প্রিন্সেসের কফিনে সম্মান জ্ঞাপনের সময়, বাকিংহাম প্যালেসের বাহিরটা ছেয়ে গিয়েছিল ফুলে। অনুমান করা যায়, প্রায় দশ লক্ষ ফুলের তোড়ায় ডুবে ছিল প্রাসাদের আঙ্গিনা। মানুষ দশ ঘন্টার উপর লাইনে অপেক্ষা করে স্মারকগ্রন্থে স্বাক্ষর করে গিয়েছিল।
নক্ষত্রখচিত বিদায়
প্রায় ১২ দিন পর ওয়েস্টমিনিস্টার হলে শায়িত থাকার পর এবার আসবে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পালা। একটা ক্যারিজে করে তার কফিন নিয়ে যাওয়া হবে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে। রানীর মৃত্যুর পর সম্ভবত পুরো বিশ্ব সবচেয়ে জৌলুসময় তারকাখচিত শেষবিদায় দেখতে পাবে। বিশ্বের আনাচে কানাচে থেকে সরকার প্রধান, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ আসবেন রানীকে বিদায় দিতে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াটি পরিচালনা করবেন “আর্চবিশপ অফ ক্যান্টারবেরি”, জাস্টিন ওয়েলবি, যিনি কিনা ব্রিটেনের দ্বিতীয় প্রবীণ ব্যক্তি (রানীর পরে)। ডেইলি বিস্টের দেয়া তথ্য অনুসারে, রানী নিজেও নাকি তার অন্ত্যষ্টিক্রিয়ার পরিকল্পনাতে বেশ ভালভাবে যুক্ত!
প্রিন্সেস ডায়ানার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সময় তার কফিন অ্যাবিতে নেয়ার মিছিল দেখতে রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ পথের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল একনজর দেখার পর। আর টিভিতে পুরো বিশ্বে বিলিয়নের উপর মানুষ দেখেছে পুরো আনুষ্ঠানিকতাটুকু। রানীর বেলায় ধরা যায় এর থেকে কম সাড়া পড়বে না, বরং প্রিন্সেসের সময়কার তুলনায় বেশিই হবে!
কোথায় হবে রানীর অন্তিমশয্যা?
রানীর কবর কোথায় হবে সেটা খুব সম্ভবত ঠিক করাই আছে। যদিও নির্দিষ্ট করে কোনো জায়গার কথা বলা যায় না, তবে সেটা স্কটল্যান্ডের স্যান্ড্রিংহাম কিংবা বালমোরালে হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। এই দুটি জায়গাই রানীর একান্ত নিজস্ব সম্পত্তি, রাজমুকুটের নয়।
অথবা তার প্রয়াত পিতা ষষ্ঠ জর্জের মতো তার শেষশয্যা সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলেও হতে পারে।
এরপর, অনেকদিন বাদে, প্রায় এক বছরের মতো সময় পর অনুষ্ঠিত হবে নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান। রূপকথার বইয়ে যেমন আমরা পড়ি রাজার অভিষেকের দিন পথে পথে ছড়ানো হয় ফুল, মণ্ডামিঠাই এর বন্যা বয়ে যায়, মানুষ নেচে গেয়ে মেতে ওঠে নতুন আনন্দে- বাস্তবের সাথে খুব একটা ফারাক নেই কিন্তু সেটার। ব্রিটেনে অনেক অনেক দিন পর এমন একটা অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে যেখানে দিনের পর দিন অবিরাম চলবে উৎসব, পার্টি আর খুশির মিছিল। অবশ্য নতুন রাজা চার্লস চাইলে তাঁর অভিষেকের উৎসব সংক্ষিপ্ত করতে পারবেন।
তবে মনে হয় না চার্লস এতদিনের পুরনো ঐতিহ্যের ব্যত্যয় ঘটাবেন। সেই অভিষেক অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হবে সেই একই ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবিতে। পরিচালনাও সেই একই মানুষ করবেন- আর্চবিশপ অফ ক্যান্টেরব্যারি।
১৯৫৩ সালে রানী এলিজাবেথের অভিষেকে এমন সাজেই সেজেছিল ব্রিটেন; Source: flashback.com
পুরো অভিষেক অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করা হবে টিভিতে এবং অনলাইনে। দেশের সব আনাচে-কানাচে, রাস্তায় রাস্তায় পার্টি দেয়া হবে, যেমনটা হয়েছিল ২০১১ সালে কেট মিডেলটন আর প্রিন্স উইলিয়ামের বিয়ের পর। তাদের বিয়ের দিন যেহেতু সরকারী ছুটি ছিল, তাতে ব্রিটেনের অর্থনৈতিকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ১.২ বিলয়ন থেকে ৬ বিলিয়নের মতো। অভিষেক উপলক্ষেও যে এমনটাই হবে তা চোখ বন্ধ করে আন্দাজ করা যায়।
আরো ছোট ছোট বিষয়গুলো…
রানী মারা যাবে, তাঁর পুত্র নতুন রাজা হবে- ব্যাস! তাতেই কি সব ফুরিয়ে গেল? জিনিসটা কি এতই সোজা?
আসলে এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে যে কতকিছুর পরিবর্তন হবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। যেমন, জাতীয় সঙ্গীত। গানের কথার পরিবর্তন হবে। রানীর বদলে গাওয়া হবে রাজার নাম। এরপর ধরা যাক, অর্থের কথা। রানীর মৃত্যুর সাথে সাথে শুরু হবে নতুন মুদ্রা ছাপানো, যার গায়ে রানীর পরিবর্তে থাকবে নতুন রাজা চার্লসের ছবি। চার্লসের কোন ছবি বসানো হবে সেটা আগে থেকেই তোলা এবং বাছাই করা আছে।
রানীর ছবি সংবলিত পাউন্ড আর একসময় থাকবে না; Source: bbc.co.uk
যদিও রাতারাতি এই নতুন টাকাগুলো পুরনোগুলোকে সরিয়ে দেবে না। পুরো প্রক্রিয়া শেষে হতে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর।
কমনওয়েলথের শেষ দেখতে যাচ্ছে পৃথিবী?
গভীরভাবে দেখলে, রানীর মৃত্যু আসলে কিছু পোস্টকার্ড কিংবা টাকা পরিবর্তনের চেয়েও বেশি কিছু। রাজনৈতিকভাবে এই মৃত্যুর প্রভাব হবে অপরিসীম। যেমন- রানীর চলে যাওয়ার সাথে সাথে ভেঙ্গে যেতে পারে কমনওয়েলথ। ৫৩টি দেশের মিলিত এই সংঘে রয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশে থাকা ১৬টি দেশ, যাদের দেশের প্রধান কাগজে-কলমে এখনো ব্রিটিশ রাজপরিবার। এই ১৬টি দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, বারবাডোজ, নিউজিল্যান্ড, জ্যামাইকা প্রভৃতি।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের যে ছাইপাঁশ আজ অবশিষ্ট আছে সেটা মূলত বাণিজ্যিক আর রাজনৈতিক এক প্রতিষ্ঠান, এর বেশি কিছু না। অতীতের সেই প্রতাপের প্রতিধ্বনিটুকুও যেন আজ নেই, দাঁড়িয়ে আছে কেবল মুকুটহীন রাজার মতো, মুকুট আছে বৈকি, তবে সেটা কেবল প্রতীকী। এ দেশগুলোর অধিকাংশই ইচ্ছের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের দাস হয়ে ছিল, প্রায় সবগুলোই বহুকাল আগে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দিয়েছে।
রানীর চলে যাওয়ার সাথে সাথে হয়তো এই দেশগুলো আরেকবার বিবেচনা করবে কমনওয়েলথে থাকার কথা।
যেমন, ধরা যাক অস্ট্রেলিয়ার কথাই। ১৯৯৯ সালে ইতোমধ্যেই একবার গণভোট হয়েছে “গণতান্ত্রিক অস্ট্রেলিয়া” হওয়ার ব্যাপারে। যদিও রিপাবলিকের সমর্থকরা খুব কম ব্যবধানের (৪৫%-৫৫%) ভোটে হেরেছিল, তবে এই ৫৫% ভোটের অনেকটাই এসেছিল মানুষের শুধুই রানীর প্রতি ব্যক্তিগত ভালোবাসা থেকে। রানীর মৃত্যুর পর যদি এই ভোট আবার নেয়া হয় তখন হয়তো পরিসংখ্যান উল্টে যেতে পারে।
আবার ধরা যাক কানাডার কথা। রানীর মৃত্যুর পর তারাও ভাবতে পারে কমনওয়েলথ ছেড়ে যাওয়ার কথা।
অবশ্য এই সুতা ছেঁড়ার বিষয়টি অনেকখানি নির্ভর করছে রানী কোন সময় মারা যাচ্ছেন সেটার উপর। কমনওয়েলথের বহু রাজনৈতিক ব্যক্তি আছেন যারা কট্টর রাজপন্থি। যেমন- অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট। তাই, যতদিন এরকম চিন্তাধারার মানুষ দেশের মাথা হয়ে থাকবে ততদিন গণপ্রজাতন্ত্রী হওয়ার এই স্রোত-মুখের ছিপি শক্তি করেই আঁটা থাকবে। তবে, রাজনীতির হাওয়া কখন কোনদিকে বয় সেটা বলা মুশকিল! রানীর মৃত্যুর সময় যদি ক্ষমতায় থাকে রিপাবলিক চিন্তাধারার মানুষজন, তাহলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হতেই পারে!
গণপ্রজাতন্ত্রী ব্রিটেন?
উপনিবেশগুলোর সাথে সাথে খোদ ব্রিটেনেও বইতে পারে রিপাবলিক হওয়ার হাওয়া। যদিও খুব শীঘ্রই ব্রিটেন রাজতন্ত্র থেকে বের হচ্ছে না, তবু দূর ভবিষ্যতে কী হতে পারে কে-ই বা জানে! যদিও রাজতন্ত্রের প্রতি ভালোবাসার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। একবারের জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ১৭% মানুষ রিপাবলিক ব্রিটেনের পক্ষে, যেখানে প্রায় ৬৬% মানুষ তার বিপক্ষে।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখে দীর্ঘতম শাসনের ক্ষেত্রে রানী ভিক্টোরিয়ার করা রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছেন রানী এলিজাবেথ। তবে সম্প্রতি রানী তার কাজকর্মের পরিসর অনেকখানি গুটিয়ে নিয়েছেন। ইতোমধ্যেই, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তিনি অনেকগুলো দাতব্য কাজ থেকে ইস্তফা নিয়েছেন।