👤 স্টাফ রিপোর্টার: জেবিন লামিয়া, নড়াইল 🕐 তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০
জরায়ুমুখ ক্যান্সার বা জরায়ুর ক্যান্সার (Cervical Cancer) নারীদের জন্য একটি ভয়াবহ ব্যাধি । জরায়ুর সবচেয়ে নিচের অংশটি হলো জরায়ু মুখ যা নারীদের সন্তান প্রসবের পথ বা যোনির সাথে সংযুক্ত । জরায়ুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে এই অংশে ক্যন্সার হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি ।
মহিলাদের জরায়ুর মুখে যে ক্যান্সার হয় তাকে জরায়ুর ক্যান্সার বলে । এই ক্যান্সার অত্যন্ত মারাত্মক যা বাংলাদেশ সহ বিশ্বব্যপী মহিলাদের মৃত্যুর দ্বিতীয় কারন । জরায়ুর ক্যান্সার সাধারনত ৩০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে বেশী হয়ে থাকে । বয়স্ক ও দরিদ্র মহিলারা জরায়ু ক্যান্সারের জন্য সর্বোচ্চ ঝুঁকি পূর্ণ ।
যে কোনো বয়সেই নারীদের এই জরায়ু ক্যান্সার হতে পারে, তবে ২০ বছরের কম বয়সীদের এ রোগ সাধারণত হয় না । কিন্তু বাল্য বিবাহ হলে বা ২০ বছরের আগে সন্তান ধারণ করলে এই মরন ব্যাধি দেখা দিতে পারে ।
একদিন বা একমাসে হঠাৎ করে জরায়ু-মুখে ক্যান্সার হয় না । জরায়ু মুখ আবরণীর কোষগুলোতে বিভিন্ন কারণে সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। এই পরিবর্তন ধীরে ধীরে ক্যান্সারের রূপ নেয় । স্বাভাবিক কোষ থেকে জরায়ু মুখের ক্যান্সার হতে প্রায় ১০-১৫ বছর সময় লাগে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে চিকিৎসার দ্বারা শতকরা ১০০ ভাগ রোগীই ভালো হয়ে যেতে পারে ।
রোগের শুরুতে উপসর্গ বা লক্ষণ গুলো অল্পমাত্রায় থাকে দেখে একে কেউ গুরুত্ব দিতে চান না । এজন্য রোগীদের পক্ষে অনেক সময়ই প্রাথমিক পর্যায়ে আসা সম্ভব হয়না । আমাদের দেশে জরায়ু-মুখ নিয়মিত পরীক্ষার জন্য কোনো ব্যবস্থা এখনও গড়ে উঠেনি । এর ফলে জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে শতকরা ৮০ ভাগ রোগীরা আসেন শেষ পর্যায়ে এবং ইতিমধ্যে ক্যান্সার ছড়িয়ে যায় এবং অপারেশন করা আর সম্ভব হয় না । সাময়ীক ভাবে জীবন বাঁচায়ে রাখতে বড় ধরনের অপারেশন প্রয়োজন হয় কিন্ত তাতেও পূর্ণ নিরাময় সম্ভব হয়না ।
জরায়ুমুখ বা জরায়ু ক্যান্সারের কারণ ঃ
মূল কারণ না জানা গেলেও নিম্নোক্ত কারণ সমূহকে জরায়ু ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় –
২টি বয়সে বেশি দেখা যায় ৩৫ বছরে এবং ৫০-৫৫ বছরে ৷অল্প বয়সে বিয়ে হলে (১৮বছরের নিচে) বা যৌন মিলন করে থাকলে ।২০বছরের নিচে গর্ভধারণ ও মা হওয়া ।অধিক ও ঘনঘন সন্তান প্রসব ।বহুগামিতা (একাধিক পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক) ।স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব এবং জননাঙ্গের অপরিচ্ছন্ন অবস্থা ।ঋতুস্রাবের সময়কালে ব্যবহৃত দুষিত কাপড় বা অপরিচ্ছন্নতা ।বিভিন্ন রোগ জীবাণু দ্বারা জরায়ু বারে বারে আক্রান্ত হলেও জরায়ু ক্যান্সারের সম্ভাবনা বেশি থাকে, যেমন – Human papilloma Virus (হিউমান প্যাপিলোমা ভাইরাস) (HPV-16, 18) ।দীর্ঘ সময়ব্যাপী (৫ বছরের বেশি সময়কাল ধরে ) জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খেলে ।
ইউরিন ইনফেকশন,ইউ-টি-আই( ইউরিনারি ট্রাক্ট ইনফেকশন)
ধূমপান বা অন্যান্য নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করলেও এই ক্যান্সার হতে পারে ।
জরায়ুমুখ বা জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ ঃ
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগের লক্ষণ নাও থাকতে পারে । তবে নিচের লক্ষণগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়-
অনিয়মিত ঋতুস্রাব হওয়া ।মাসিকের সময় রক্তপাতের পরিমান স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি এবং দীর্ঘমেয়াদী হওয়া ।দুই মাসিক এর অন্তর্বর্তী সময়ে হালকা রক্তপাত হওয়া ।মাসিক বন্ধ হবার পরও মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তপাত হওয়া ।ঋতু সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ১ বছর পরেও রক্তস্রাব দেখা যাওয়া । নিন্মাঙ্গের চারপাশে চাপ লাগা কিংবা ঘন ঘন মূত্রত্যাগ করা ।যোনিপথে বাদামি অথবা রক্তমিশ্রিত স্রাবের আধিক্য দেখা দেওয়া ।সাদা দুর্গন্ধযুক্ত যোনিস্রাব হওয়া ।
এছাড়াও গ্যাস, বদহজম, কোষ্ঠকাঠিন্য হালকা খাবারের পর পেট ভর্তি লাগা, পেটে অস্বস্তি লাগা ইত্যাদি পেটের কোনো সমস্যা খুব বেশি হলে তা জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে, অন্য সময়ের থেকে পেটে অনেক পরিবর্তন দেখা দেওয়া, পেটে অতিরিক্ত ব্যথা কিংবা পেট ফুলে থাকা, বমি বমি ভাব কিংবা বার বার বমি হওয়া, ক্ষুধা কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া কিংবা ওজন অনেক বেশি কমে যাওয়া, অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা, নারীদের মেনোপজ হওয়ার পরেও ব্লিডিং হওয়া ।
জরায়ুমুখ বা জরায়ু ক্যান্সারের রোগ নির্ণয় ঃ
জরায়ুর মুখে ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের Screening Test রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম টেস্ট হচ্ছে –
পেপস স্মেয়ার টেস্ট (Pap Smear Screening Test)VIA (Visual Inspection with Acetic Acid) Test যে কোনো একটি টেস্ট করার মধ্যমে খুব সহজে রোগ নির্ণয় করা সম্ভব । সকল সরকারী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, সূর্যের হাসি চিহ্নিত ক্লিনিক, মেরিস্টোপস্ ক্লিনিকে পরীক্ষাটি বিনামূল্যে করানোর সুযোগ রয়েছে।
জরায়ুমুখ বা জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা ঃ
প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে চিকিৎকের পরামর্শ অনুসারে চললে সম্পূর্ণ ভালো হওয়া যায়।মধ্য পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া যেতে পারে৷কিন্তু দেরী হয়ে গেলে রোগ ছড়িয়ে পরলে সার্জারি এবং কেমোথেরাপি বা রেডিও থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা দিয়ে রোগিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। তবে এই কেমোথেরাপি এবং রেডিও থেরাপি অনেক ব্যায় বহুল ।
জরায়ুমুখ বা জরায়ু ক্যান্সারের প্রতিরোধ ঃ
রোগের চিকিৎসার পরিবর্তে প্রতিরোধ অর্থাৎ রোগটা হতে না দেওয়ার জন্য আমাদের যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন –
জরায়ুমুখ বা জরায়ু ক্যান্সারের প্রতিরোধক টিকা গ্রহণ করা । তবে টিকা গ্রহণ করার আগে অবশ্যই রোগ নির্ণয়ের জন্য সর্ব প্রথম VIA Test বা Pap Smear Test করতে হবে । কারণ ক্যান্সার হয়ে যাওয়ার পর টিকা দিলে কোনো কাজে আসে না বা ক্যান্সারের গতিরোধ করতে পারে না ।বিয়ে বা যৌন সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই এই টিকা নেয়া উচিত কারণ এইচপিভি ইনফেকশনে জরায়ুতে পরিবর্তন হতে শুরু করলে টিকা তা দমন করতে পারে না ।প্রতি তিনবছর অন্তর স্বাস্থ্যকর্মীকে দিয়ে জরায়ু-মুখ অবশ্যই পরীক্ষা করাতে হবে ।