শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:১৪ অপরাহ্ন

পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স নিবন্ধন কার স্বার্থে?- সম্পাদকীয়

Reporter Name
  • Update Time : রবিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
  • ১৮১২ Time View
ছবিঃ মিডওয়াইফারি শিক্ষার্থীরা

পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স হিসেবে  নিবন্ধন কার স্বার্থে?
লেখকঃ আবুল মনসুর

সাম্প্রতিক সময়ে মিডিয়ার কল্যানে জানতে পারলাম কারিগরি শিক্ষাবোর্ড পরিচালিত পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজিস্টদের নার্স হিসেবে নিবন্ধন দেওয়ার জন্য নার্সিং ও মিডওয়াইফারী কাউন্সিলকে নির্দেশনা প্রদান করেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রাণালায় এতে নার্সদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরী হয়েছে। নার্সরা রাস্তায় আন্দোলনে নেমেছেন। যাদের মমতায় পরশে রোগীরা সুস্থ হন সেই নার্সরা আজ বিক্ষোভ করেছেন সারাদেশে এবং আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে।ব্যাপারটা আমাদের মতো কয়েকজন মানুষের মনে দাগ কেটেছে। বিষয়টি নিয়ে অনেক কিছু পড়ার পর জানালাম  ২০০৫ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মেডিকেল টেকনোলজিতে ডিপ্লোমা চালু করার পর থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে এক মত হতে পারেনি প্রতিষ্ঠানগুলো।

২০১৮ সালের ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (ডেন্টাল, ফিজিওথেরাপি, ইন্টগ্রেটেড মেডিকেল, ফার্মাসি, নার্সিং, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং, প্যাথলজি, অপটিকেল রিফ্রাকশনসহ অনুরূপ কোর্স) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন কারিগরি বোর্ডের অধীনে চলবে। ওই সময় সংসদীয় কমিটির মাধ্যমে এসব কোর্স পরিচালনার একটি নীতিমালাও করা হয়।

যদিও ২০২০ সালের ৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজিকে কারিগরি বোর্ডের অধীনে না রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়।

পরে একই বছরের ২০ ডিসেম্বর নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজি সংক্রান্ত বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ বাস্তবায়ন সংক্রান্ত মনিটরিং কমিটির ৫ম সভায় কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাভুক্ত সব নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজি কোর্স পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও নিবন্ধন/অধিভুক্তিকরণের বিষয়ে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানগুলো নিবন্ধনের জন্য বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলে আবেদন করবে এবং নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজি সংক্রান্ত সব প্রশিক্ষণ কোর্স স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতায় পরিচালিত হবে।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান আইন/নীতিমালা অনুসরণে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অনুমোদন ও রাষ্ট্রীয় চিকিৎসা অনুষদ এবং বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল আইন অনুযায়ী স্বীকৃতি সাপেক্ষে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজি সংক্রান্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের মধ্যে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনের লক্ষ্যে গত ১৭ জানুয়ারি ২০২০ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে করণীয় নির্ধারণ সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নিজেদের দেওয়া শিক্ষাকে তুলনামূলক মানহীন বলে আখ্যা দেন।

ওই সভার কার্য বিবরণী থেকে জানা যায়, কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের আওতাধীন নার্সিং শিক্ষার্থীদের সিলেবাস ও শিক্ষার মান, বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের তুলনায় বেশ ঘাটতি রয়েছে। অবশ্য এই শিখন ঘাটতি পূরণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগও নিতে বলা হয়েছে। এমনকি চাকরিতে আবেদনের ক্ষেত্রে কারিগরি বোর্ডের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পর সুযোগ প্রদানের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে বলা হয়।

ওই সভায় আবারও ওয়ান আমব্রেলা পদ্ধতি কার্যকর করতে বলা হয়।
এর আগে ২০০৭ সালে ১৮ নভেম্বর দেশে দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিস্টের চাহিদা নিরূপণ এবং তা পূরণে করণীয় নির্ধারণের জন্য গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটির প্রতিবেদনে ৩টি সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়। সেখানে এই ওয়ান আমব্রেলা কনসেপ্ট বাস্তবায়ন করার কথা বলা হয়েছিল।

তখন বলা হয়েছিল, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ওয়ান আমব্রেলা কনসেপ্টের আওতায় স্বাস্থ্য প্রযুক্তি ও সেবা শিক্ষাক্রম সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাবলী পরিচালনার জন্য প্রচলিত আইন সংশোধনে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে আইন চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ড পরিচালিত মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউটগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রণীত কারিকুলাম ও সিলেবাস অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

আইন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ কারিগরি বোর্ড পরিচালিত স্বাস্থ্য প্রযুক্তি সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে একটি কমিটির মাধ্যমে যৌথভাবে তদারকি (মনিটরিং) করতে হবে।

কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৪০০ টি এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের প্রায় এক লাখ শিক্ষার্থী নিবন্ধন চাইছে।
২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন ‘ডিপ্লোমা ইন নার্সিং’ কোর্সের স্বীকৃতি ও রেজিস্ট্রেশনের জন্য ‘পেশাগত সনদ বা লাইসেন্স’ পেতে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারের কাছে চিঠি দেন। নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার একই বছরের ১৯ অক্টোবর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর ‘কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন পরিচালিত ডিপ্লোমা ইন নার্সিং কোর্সটি আইনের আওতাধীন নয়’ বিধায় তাদের রেজিস্ট্রেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করা সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেন।

নার্সিং কাউন্সিল থেকে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে জানায়, ‘বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের আইন বলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রণীত নার্সিং ইনস্টিটিউট স্থাপনের নীতিমালা অনুযায়ী নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন প্রদান করে। অতঃপর কাউন্সিল যথাযথ প্রক্রিয়ায় স্বীকৃতি অথবা অধিভুক্তি প্রদান করে।’ নার্সিং কাউন্সিল কারিগরি শিক্ষা বোর্ডকে জানায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিনা অনুমতিক্রমে কোর্স চালুর বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়া এবং নার্সিং শিক্ষা কারিকুলাম পরিচালনা যথাযথ বিধি পালন না করায় বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ‘নার্সিং কোর্স চালু এবং পরিচালনা’ করে বাংলাদেশের জনগণের কাছে নার্সিং শিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড প্রথমে ২০০৯ সালে ‘ডিপ্লোমা ইন পেসেন্ট কেয়ার টেকনোলজি’ নামে তিন বছরের একটি কোর্স চালু করে। পরে ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর কারিগরি বোর্ডের ১৪৪তম সভায় কোর্সটিকে ‘ডিপ্লোমা ইন নার্সিং টেকনোলজি’ নামকরণ করে তিন বছর থেকে চার বছরে উন্নীত করে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি প্রদান করে জানায় যে, ‘ডিপ্লোমা ইন পেসেন্ট কেয়ার টেকনোলজি’ থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীরা ‘ডিপ্লোমা ইন নার্সিং টেকনোলজি’ কোর্সের শিক্ষার্থীদের মতো সমমানের কাজ করতে সক্ষম। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে এরপর ২০১৭ সালের ১৫ অক্টোবর বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রারের কাছে কারিগরি বোর্ড থেকে পাসকৃত ‘ডিপ্লোমা ইন নার্সিং’ কোর্সের ছাত্রছাত্রীদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদানের দাবি জানানো হয়।

বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে কারিগরি বোর্ডের দাবি পূরণ না করে ‘লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া সম্ভব নয়’ বলে জানিয়ে দেয়। এতে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয় এবং উচ্চ আদালত বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের লাইসেন্সিং পরীক্ষায় স্থগিতাদেশ দেন। এ কারণে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল অনুমোদিত ডিপ্লোমা নার্সরা লাইসেন্সিং পরীক্ষা দিতে পারেননি।

কারিগরি বোর্ডের ‘ডিপ্লোমা ইন পেশেন্ট কেয়ার টেকনোলজি’ কোর্সের শিক্ষার্থীরা কেন রেজিস্ট্রেশন অথবা লাইসেন্স পাবে না?

১. আইনগত জটিলতাঃ
বাংলাদেশ না নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের আইনের আওতায় স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে এই কাউন্সিলের অনুমোদিত কারিকুলাম অধ্যয়ন শেষে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে একজন নার্স রেজিস্ট্রেশন পেতে পারে।’ এর বাইরে অনুমোদনহীন কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো কোর্সকে নার্সিং কাউন্সিল স্বীকৃতি দিতে পারে না। কারণ এই প্রতিষ্ঠান সংবিধিবদ্ধ আইনের অধীন।’

২. পড়াশোনার মান নিয়ে প্রশ্নঃ
.নার্সিং কোর্স পড়াতে হলে হাসপাতালের প্রয়োজন। তিন বছরের ডিপ্লোমা নার্সিং কোর্সে একজন শিক্ষার্থীকে মোট পাঁচ হাজার ৬৪ ঘণ্টা খাটতে হয়। এর মধ্যে দুই হাজার ৮৮ ঘণ্টা থিওরি পড়তে হয়। ৫২৮ ঘণ্টা ল্যাবরেটরিতে সময় ব্যয় করতে হয় এবং অবশিষ্ট দুই হাজার ৪৮৮ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় হাসপাতালে রোগীর সাথে। পক্ষান্তরে  বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের কোনো হাসপাতাল ওয়ার্ক নেই। একজন নার্স চিকিৎসকের পরই রোগীর জন্য অপরিহার্য। যথাযথ ব্যবহারিক শিক্ষা নিতে না পারলে ওই নার্সের অধীন রোগীতো সুস্থ হবেই না বরং রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। কোনো অভিভাবকই চাইবেন না তার স্বজনরা অদক্ষ নার্সের হাতে পড়ে মারা যাক। আইনের মাধ্যমে গঠিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কাউন্সিল হাসপাতালের অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনো নার্সকে রেজিস্ট্রেশন দিতে পারে না।

৩. ক্লিনিক্যাল প্রাকটিস বিহীন পড়াশোনাঃ
২০১৬ সালের আইন অনুযায়ী ২০ জন নার্সিং শিক্ষার্থীর জন্য ১০০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল প্রয়োজন। যাদের হাসপাতাল রয়েছে তাদেরকে নার্সিং কাউন্সিল নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুমোদন দিয়ে থাকে আবেদন করলে। কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীন কোর্সের শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষার জন্য হাসপাতাল প্রয়োজন। হাসপাতাল ছাড়া এবং যথাযথ অনুমোদন ছাড়া কোনো কোর্সের অনুমোদন দেয়া উচিত নয়।

লেখক ঃ এনজিও কর্মকর্তা।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
© All rights reserved © 2021
Design & Developed by Freelancer Zone
themesba-lates1749691102