স্টাফ রিপোর্টার:এ.কে.সরকার
বতর্মান সময়ে ও আমাদের গ্রাম গুলো তে কথিত আছে বাবা মায়ের খারাপ কাজের ফলস্বরূপ সন্তান জন্মের সাথে সাথে সন্তানের শারীরিক কিংবা মানসিক ত্রুটি নিয়ে পৃথীবিতে আসে।
এমন ভ্রান্তধারণা কে পোষণ করে আমাদের প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ নানা বিধি জটিল রোগ গুলোকে অনিহা, অবহেলা করে শিশু মৃত্যুর হার কে বাড়াচ্ছে।
থ্যালাসেমিয়া তথাপি তেমনি একটি রোগ।
এই রোগ টি সাধারণত শিশুর জন্মের পূর্বেই আক্রান্ত হয়ে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া একটি অটোজোমাল মিউট্যান্ট প্রচ্ছন্ন জিনঘটিত বংশগত রক্তের রোগ। এই রোগে রক্তে অক্সিজেন পরিবহনকারী হিমোগ্লোবিন কণার উৎপাদনে ত্রুটি হয়। থ্যালাসেমিয়া ধারণকারী মানুষ সাধারণত রক্তে অক্সিজেনস্বল্পতা বা “অ্যানিমিয়া”তে ভুগে থাকেন। অ্যানিমিয়ার ফলে অবসাদগ্রস্ততা থেকে শুরু করে অঙ্গহানি ঘটতে পারে। থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: ১) আলফা থ্যালাসেমিয়া ২) বিটা থ্যালাসেমিয়া। সাধারণভাবে আলফা থ্যালাসেমিয়া ß থ্যালাসেমিয়া থেকে কম তীব্র। আলফা থ্যালাসেমিয়াবিশিষ্ট ব্যক্তির ক্ষেত্রে রোগের উপসর্গ মৃদু বা মাঝারি প্রকৃতির হয়। অন্যদিকে বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে রোগের তীব্রতা বা প্রকোপ অনেক বেশি; এক-দুই বছরের শিশুর ক্ষেত্রে ঠিকমত চিকিৎসা না করলে এটি শিশুর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। আলফা থ্যালাসেমিয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সর্বত্র এবং কখনও কখনও ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লোকদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১ লক্ষ শিশু থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জিনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা- মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়।এক সমীক্ষায় দেখা যায়,বাবা এবং মা উভয়ের থ্যালাসেমিয়া জীন থাকলে ভূমিষ্ট শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
থ্যালাসেমিয়া দুইটি প্রধান ধরনের হতে পারে: আলফা থ্যালাসেমিয়া ও বিটা থ্যালাসেমিয়া।
আলফা থ্যালাসেমিয়া :এই রোগের জন্য 16 নং ক্রোমোজোমে উপস্থিত আলফা-শৃঙ্খল উৎপাদনকারী জিনের (mutation) বা (deletion) দায়ী।
চারটি জিন দিয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়া শিকল তৈরি হয়। বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে আলফা থ্যালাসেমিয়া হয়। যত বেশি জিন ত্রুটিপূর্ণ হবে তত বেশি মারাত্মক সমস্যা দেখা দিবে।
একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে থ্যালাসেমিয়ার কোন লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যাবে না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে তার সন্তানের মধ্যে এই রোগ ছড়াবে।
দুইটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যাবে। এই অবস্থাকে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Alpha-thalassemia minor) অথবা আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট ( Alpha-thalassemia trait).
তিনটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে এর উপসর্গগুলো মাঝারি থেকে মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থাকে বলে হিমোগ্লোবিন এইচ ডিজিজ (Hemoglobin H Disease)।
চারটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে একে বলে আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (Alpha thalassemia major) অথবা হাইড্রপস ফিটালিস (Hydrops fetalis)। এর ফলে প্রসবের (delivery) পূর্বে অথবা জিনের পরপর ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায়।
বিটা থ্যালাসেমিয়া: বিটা থ্যালাসেমিয়া শিকল গঠিত (Chain) হয় দুইটি জিন দিয়ে।
বাবা-মা থেকে প্রাপ্ত চারটি জিনের মধ্যে এক বা তার অধিক ত্রুটিপূর্ণ হলে বিটা থ্যালাসেমিয়া হয় এক্ষেত্রে :
একটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে হালকা উপসর্গ দেখা যায়। এই অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (Beta-thalassemia minor) অথবা বিটা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট (Beta-thalassemia trait).
দুটি জিন ত্রুটিপূর্ণ হলে মাঝারি থেকে মারাত্মক উপসর্গ দেখা যায়।
এ অবস্থাকে বলে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর ( Beta-thalassemia major) অথবা কুলিস অ্যানিমিয়া (Cooley’s anemia)। নবজাতক যেসব শিশুর এই সমস্যা থাকে তারা জন্মের সময় বেশ স্বাস্থ্যবান থাকে। তবে জন্মের প্রথম দুই বছরের মধ্যেই এর উপসর্গ দেখা যায়।
বিশ্বের আনুমানিক ৬০-৮০ মিলিওন মানুষ বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে।থ্যালাসেমিয়া স্বল্প উন্নত দেশ যেমন নেপাল,বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে বেশি দেখা যায়।আশঙ্কা করা হচ্ছে,আগামী ৫০ বছরে থ্যালাসেমিয়া অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
মাইনর থ্যালাসেমিয়াতে সাধারণত চিকিৎসা প্রয়োজন হয় না।থ্যালাসেমিয়া মেজরে নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন প্রধান চিকিৎসা।
বার বার রক্ত নেবার একটি বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া।
এর ফলে যকৃত বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে।এধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপী দেয়া হয়,অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেবার জন্য।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন থ্যালাসেমিয়ার একটি কার্যকরী চিকিৎসা।
প্রতিরোধ সম্পাদনা
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করা খুবই সম্ভব। এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। যদি স্বামী-স্ত্রী দুজনই থ্যালাসেমিয়া বাহক বা একজন থ্যালাসেমিয়া বাহক এবং একজন হিমোগ্লোবিন ই এর বাহক হয় তবে প্রতি গর্ভাবস্থায় –
এ রোগে আক্রান্ত শিশু জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ ।
বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ৫০ভাগ।
আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা থাকে শতকরা ২৫ ভাগ।
স্বামী স্ত্রী দুজনের যেকোন একজন যদি সম্পূর্ণ সুস্থ থাকেন, তাহলে নবজাতকের থ্যালাসেমিক হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। তবে নবজাতক থ্যালাসেমিয়ার বাহক হতে পারে যা কোন রোগ নয়।
তাই এ রোগের বাহকদের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত এবং প্রতিহত করার মাধ্যমে সমাজে নতুন থ্যালাসেমিক শিশুর জন্ম হ্রাস করা যায়। সুতরাং দেরী না করে আজই থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় এর জন্য হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফোরেসিস নামক পরীক্ষাটি করানো উচিত।