আফরিন, ঢাকাঃ শ্বাসকষ্ট নিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আজহারুল ইসলাম (৪৫)। চিকিৎসক ওষুধ দিয়ে যাওয়ার পরও তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। কর্তব্যরত নার্স তাকে পুনরায় ওষুধ দেন। এরপরও রোগী অভিযোগ করেন, শ্বাসকষ্ট কমছে না। বিষয়টি বুঝতে পেরে নার্স তার পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘চাচা, আপনার কয় ছেলেমেয়ে? তারা এখন কী করে?’ আজহারুল ইসলাম একে একে তার পরিবারের সদস্যদের গল্প বলা শুরু করেন। কয়েক মিনিট পরে নার্স জিজ্ঞেস করেন, ‘চাচা আপনার কি শ্বাসকষ্ট আছে?’ তিনি বলেন, ‘না।’ তখন নার্স বলেন, ‘চাচা, আপনি এখন একটু চোখ বন্ধ করে ঘুমান। আমি অন্য রোগী দেখি।’
দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে এভাবেই প্রতিনিয়ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন নার্সরা। চিকিৎসকের দেওয়া চিকিৎসা এবং নার্সের সেবায় সুস্থ হয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা।
বলা হয়, নার্সরা চিকিৎসকদের সবচেয়ে বড় সহযোগী। দেশের নার্সিং ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘বাংলাদেশের নার্সদের অবস্থা এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করার পর তাদের অবস্থার আমূল পরিবর্তন এসেছে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু পদমর্যাদা উন্নীত করেই থেমে যাননি প্রধানমন্ত্রী, ১৬৩টি পদকে প্রথম শ্রেণির মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। এছাড়া এইচএসসি পাস নার্স এবং বিএসসি নার্সিং, এমএসসি এবং পিএইচডি পর্যন্ত তাদের জন্য চালু রয়েছে। বর্তমানে ১৪ হাজার নার্স সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ দেওয়ায় নার্সিং সেবায় অনেক পরিবর্তন এসেছে।’ তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী, প্রতি একজন চিকিৎসকের সঙ্গে তিনজন নার্স এবং পাঁচজন সাপোর্ট স্টাফের বিষয়ে যে নির্দেশনা আছে বাংলাদেশে এখনও তা হয়নি বলে জানান তিনি। ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া এ-ও আশা করেন, আগামী ১০ বছরের মধ্যে নার্সিং সেক্টর দেশের একটা উন্নত সেক্টরে পরিণত হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, সরকার নার্সদের জন্য অনেক কিছু করেছে। এখন তাদের দেওয়ার পালা। তাদের শিক্ষায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিকীকরণ— এই বিষয়গুলো থাকা দরকার। নার্সিং ইনস্টিটিউটে পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকের পদের পরিবর্তন দরকার।
বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের তথ্যমতে, ডিপ্লোমা নার্স, বিএসসি নার্স মিডওয়াইফারি সব মিলিয়ে তাদের সংখ্যা প্রায় ৫৬ হাজার। বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিলের হিসাবে বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ৩ লাখ নার্সের প্রয়োজন। বিশ্বের ১৩টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় ৬ হাজার ৫০০ নার্স কর্মরত আছেন।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘নার্স রোগীর জন্য একটা আলোকবর্তিকা। যিনি রোগীর রোগাক্রান্ত মানসিক অবস্থায় তার সহানুভূতি ও মমতার হাত বাড়িয়ে দেবেন, যাতে রোগীর রোগের চিকিৎসা ও মনের চিকিৎসা— দুটোই একসঙ্গে হয়।’ নার্স একজন রোগীর জন্য মায়ের মতো বলে মনে করেন তিনি।
ডা. নোমান বলেন, ‘নার্সদের ভূমিকা রোগের চিকিৎসা নয়, রোগীর চিকিৎসা হওয়া উচিত। রোগীর সঙ্গে কাউন্সেলিং করা, রোগীকে মানসিক শক্তি জোগানো, এগুলো নার্সের মূল কাজ, কিন্তু আমাদের দেশে অনুপস্থিত।’
এর কারণ হিসেবে ডা. নোমান বলেন, ‘মূল কারণ তাদের শিক্ষা পদ্ধতির ঘাটতি। একজন রোগীকে মানুষ হিসেবে দেখে তাকে সক্ষম মানুষের দিকে নিয়ে যাওয়ার মানসিকতায় নার্সদের ঘাটতি আছে। দায়িত্ব না নেওয়ার মানসিকতা নার্সদের মধ্যে প্রকট। শুধু ৮ ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের মানসিকতা থাকলে কখনও নার্সিং সেবা হবে না।’ দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল সংকট নার্সিং সেবার সংকট বলেও মন্তব্য করেন তিনি। ডা. নোমানের মতে, আমাদের নার্সিং পেশা নিয়ে কেউ কথা বলছে না। মূলত সংকট হচ্ছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সংকট। এর মূলে নার্সিং ব্যবস্থাপনার সংকট। নার্সিং চিন্তা আলাদা, চিকিৎসকের চিন্তা আলাদা, রোগীর চিন্তা আলাদা, সাধারণ মানুষের চিন্তা আলাদা— এইসব চিন্তার সমন্বয় হচ্ছে না। ফলে মূল চিকিৎসাব্যবস্থার সংকট থেকেই যাচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমাদের পাশের দেশ ভারতের কেরালার নার্সদের আচরণ ভালো। আর এতেই কাজ হয়। আমাদের নার্সদের আচরণ অন্য রকম। তারা শুরুতেই ইনফিউরিটি কমপ্লেক্সে ভোগেন। যার কারণে, তাদের কোনও পরামর্শ দিলে তারা সেটাকে অপমান হিসেবে নেন। এ কারণে সংকটগুলো থেকেই যাচ্ছে।’
ইন্টারনাল মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের দেশের নার্সিং ব্যবস্থাপনা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। এটা রোগী থেকে শুরু করে সবারই অভিযোগ।’ সম্ভবত নার্সদের ট্রেনিং ভালো হয় না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের নার্সিং ব্যবস্থা দুর্বল। চিকিৎসা পেশাটা আসলে টিমওয়ার্ক। আমাদের চিকিৎসকদের যেমন দুর্বলতা আছে, তেমনি নার্সিং ব্যবস্থাটাও বেশ খারাপ অবস্থায় আছে। এটির উন্নয়ন করা দরকার।’
ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমি একজন রোগী দেখে দিলাম, এরপর বাকি কাজটুকু তো নার্সের। তার ভালো হচ্ছে কিনা, তিনি ওষুধপত্র পান কিনা, এটা তো নার্সকে দেখতে হবে।’ নার্সিং সেবাটা ভালো না হলে পুরো দোষটা এসে ডাক্তারের ঘাড়ে পড়ে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন করতে চাইলে অবশ্যই নার্সিং ব্যবস্থাপনাটা ভালো হতে হবে।’